নিশুতি রাত শেষে পূর্বদিগন্তে লালাভাব একখানা গোলাকার সূর্য উকি দিচ্ছে।হয়তো কিছুক্ষণ পরেই সকাল হবে।বাস থেকে নেমে আসলো দুই তরুণী।চোখমুখ তাদের কালো মেঘে ঢাকা।অতিরিক্ত চিন্তার কারণে দুজনেরই মুখ শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে গিয়েছে।বাসস্ট্যান্ডে তেমন মানুষজন নেই। সকাল হতে এখনো অনেকটা দেরি। পরিচিত কোনো রিকশা বা কাউকে পেল না।
রাখি আশেপাশে তো কোনো রিকশা নজরে পড়ছে না।এমনিই অনেক দেরি করে ফেলেছি আমরা। এখন কি হবে?
চল একটু সামনে এগিয়ে দেখি রিকশা পাই কিনা।
জমিলার ফোন পেয়ে তখনি বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে তারা। বাসে উঠার আগে রেনুকা শেখকে ফোন দিয়ে শুধু বলেছে যে তারা গ্রামে যাচ্ছে আর কিছু বলার আগেই ড্রাইভার বাসে উঠার জন্য তাড়া দিতেই কল কেটে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়েছে। তারপর সারাপথে দুজনে শুধু একটাই দোয়া করেছে তাদের বাবা যেন ভালো থাকে,, সুস্থ থাকে।
অনেকটা হাটার পর একটা রিকশা পেলো ওরা। তবে যেতে চাইছিল না ভাড়া দ্বিগুণ দিয়ে কোনোমতো রাজি করিয়েছে।
রিকশা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই গেটের সামনে অনেক মানুষের ভিড় দেখে আখিয়া,, রাখিয়ার বুকটা ছ্যাত করে উঠল।রিকশা থামিয়ে দুজনে ভিড় ঠেলে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সামনে দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
তাদের সামনে খাটিয়ার উপর কাফনের কাপড়ে আবৃত নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তাদের প্রাণপ্রিয় বাবা। দুনিয়াবি কোনোকিছুতে এখন তার আর কোনো টান নেই।এই দুনিয়ায় তার অস্তিত্ব শেষ করে সে এখন দুচোখ বন্ধ করে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে।কিন্তু তিনি যে তার প্রাণের দুটি অংশকে এতিম করে দিয়ে চলে গেলেন সে খেয়াল কি তার নেই?উঁহু এটা বললে ভুল হবে মরার আগ পর্যন্ত হয়তো তার খেয়ালে শুধুই তার রাজক্যানরা ছিল কিন্তু এখন,,এখন তার আর এসবের সাথে কোনো মায়া নেই।তিনি তো এখন নিজের পরকালের দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত।
আব্বুউউউ বলে একটা জড়ে চিৎকার দিয়ে রাখিয়া সেন্সলেস হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে জমিলা দৌড়ে এসে ওকে আগলে নিলো। বাবার আকৎসিক মৃত্যুর ধাক্কাটা মেনে নিতে পারেনি সে।মহিলারা সবাই ওকে ধরাধরি করে রুমে এনে শুইয়ে দিল। তারপর তার জ্ঞান ফিরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এদিকে আখিয়া এখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তার আব্বুর স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখখানির দিকে আপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে।দুনিয়ায় সবথেকে ভয়ংকর কষ্ট,,তার আব্বু তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে এটা সে এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি হয়তো।তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে শুধু এখন তার আব্বুর সুন্দর মায়াবী মুখটা দেখতেই ব্যস্ত,, যেন আজ আব্বুকে দেখার তৃষ্ণা মিটছে না তার।ইশশ তার আব্বুকে কি পবিত্র লাগছে,, কি সুন্দর মুখায়ব আব্বুর।
সকলে অবাক চোখে এই প্রথম এক শান্ত আখিয়াকে দেখছে। আখিয়া ধীর পায়ে হেটে গেল ওর আব্বুর কাছে।তারপর তার খাটিয়ার পাশে বসে একহাত এগিয়ে নিলো আব্বুর মুখের কাছে।সারামুখে হাত বুলিয়ে বুলতে লাগল,,আমার আব্বু,, আমার সোনা আব্বু।তোমাকে কি সুন্দর লাগছে জানো। তোমার মুখটা বড্ড পবিত্র,,স্নিগ্ধ লাগছে।তুমি কথা বলছ না কেন আব্বু?কথা বলো।তোমার মিষ্টি গলার সুরটা একটু শুনি।আমাকে আঁখি আম্মা বলে এখনো ডাকলে না যে।
দেখো তোমার আঁখি,,রাখি এসেছে।তোমার ছোট্ট ছানাগুলোকে বুকে টেনে নেবেনা আব্বু?
এখনো তার আব্বু তার সাথে কথা বলছে না দেখে কেমন করে যেন একটু হাসল আখিয়া হাসিটা বড় অদ্ভুত দেখাল। তারপর দুহাতের আঁজলায় তার আব্বুর মুখটা নিয়ে বলতে লাগল,,আমি আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।এখন থেকে সব সময় তোমার সাথে থাকব,, তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব,,তোমার হাতে খাইয়ে নিব। আম্মু তো খুব সার্থপর ছিলো তাই না আব্বু বলো। কেমন ছোটতেই আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।কিন্তু তুমি তো আমাদের বেস্ট আব্বু তুমি কখনো এমন সার্থপরতা করবা না হ্যাঁ।তুমি তো জানো আব্বু আমারা তোমাকে কত ভালোবাসি।কি হলো বলো,, বলো জানো না তুমি?বলছ না কেন বলো?
একটু ঝাঁকিয়ে এবার জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে বলল,,আব্বু বলো। চুপ করে আছো কেন,, বলো আব্বুউউউ,, আব্বুউউ বলো।
কয়েকজন মুরুব্বি মিলে আখিয়ার পাগলামো দেখে তাকে এবার জামান রহমানের লাশের কাছ থেকে টেনে দূরে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু আখিয়া চিৎকার করতেই আছে।সবার সাথে কুস্তি লড়ছে,,ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। বারবার বলছে আমি আমার আব্বুর কাছে যাব ছেড়ে দেও আমাকে। আব্বু উঠে যদি দেখেছে তোমরা আমার সাথে এরকম করছ,, তার থেকে আমাকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ তাহলে কিন্তু তোমাদের শাস্তি দিবে।
হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল।আখিয়ার ব্যবহার খুবই অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে এখন। এতোজন মানুষ মিলেও তার সাথে পেরে উঠছে না।
এক ঝটকায় নিজেকে কোনো মতে একটু ছাড়িয়ে নিয়ে আবার ছুট লাগালো তার আব্বুর দিকে।জমিলাসহ অনেকে আবার ওকে চেপে ধরল।কেমন পাগল পাগল লাগছে আখিয়াকে।ছটফট,,টানাহেঁচড়ার করছে তো করছেই।এরি মাঝে হঠাৎ তার ডান গালে জোড়ে কেউ থাপ্পড় মারল।
নিজের ডান গালে হাত দিয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল আখিয়া। সামনে দাড়ানো রাখিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ।
রাখিয়ার জ্ঞান কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে।জ্ঞান ফিরতেই ও দৌড়ে ওর আব্বুর কাছে এসেছে।এসে আখিয়ার পাগলামি দেখছিল আর বুক ভাসিয়ে কাদছিল।
রাখিয়া আখিয়ার দুই বাহু চেপে ধরে ওকে জোড়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল,,আমাদের আব্বু আর নেই।চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।তুই কি বুঝতে পারছিস না আখিয়া নাকি বুঝেও অবুঝ এর মতো আচরণ করছিস।কেন এরকম পাগলামি করছিস?মারা গেছে আমাদের আব্বু। সত্যিটা আমাদের মেনে নিতে হবে।আব্বুর দাফনের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে আমাদের আব্বু বুঝতে পারছিস কিছু।
আখিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এখনো।দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে।ওর মধ্যে কোনো হেলদল নেই।
কিছুক্ষণ পর ধুপ করে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল আখিয়া।তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে,, সর্বোচ্চ জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,,
ইয়া আল্লাহ্হহহহ,,কি করলে আমাদের সাথে এটা।এই দুনিয়ায় আমাদের তো আর কেউ থাকলো না।
আমাদের আব্বু ছাড়া কেউ নাই আমাদের কেন আমাদের সাথে এরকম করলে। আল্লাহহহহহ,আমি যে সহ্য করতে পারছি না।বুকের মধ্যে জোড়ে জোড়ে চাপড়িয়ে বলতে লাগল,,আয়ায়ায়া আমার বুক ফাকা ফাকা লাগছে আল্লাহ।আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।আমাদের মাথার উপর থেকে এতো বড় ছাদটা এভাবে কেড়ে নিলে কেনো।তারপর মাটিতে দুহাত দিয়ে পাগলের মতো আঘাত করতে করতে আবার বলল,,আমি কার বুকে মাথা রেখে ঘুমাব এখন।কে আমাকে আঁখি আম্মা বলে ডাকবে।আমাদের তো আর কেউ রইল না।
আখিয়ার এমন করুণ আহাজারিতে উপস্থিত সকলের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।মহিলাদের কেউ কেউ এই আহাজারি সহ্য করতে না পেরে মুখ ঢাকিয়ে কাদছে।
আখিয়ার কাছে বসে আখিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরল রাখিয়া।বাধনহারা কান্না কাদছে আখিয়া। রাখিয়াও আখিয়ার সমান তালে কেদে চলেছে। দুবোন একে অপরকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাদছে। আহহহ কি করুণ সেই দৃশ্য...
(আমার এক বড় আপু তার আব্বু মারা যাওয়ার পর এরকমভাবে কেদেছিল।কি যে কষ্টের কান্না ছিল সেটা তো বলে বা লিখে প্রকাশ করার মতো নয়।তার কিছু অংশই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।পৃথিবী থেকে যারা চলে গিয়েছেন আল্লাহ তাদের সকলকে জান্নাত নসিব করুক।আমিন)
0 Comments